ডেঙ্গু জ্বর এবং এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ
বর্তমান সময়ে বহুল আলােচিত বিষয়গুলাের অন্যতম ডেঙ্গু জ্বর। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এই জ্বরের প্রভাব পুরােনাে হলেও সাম্প্রতি কিছু বছর ধরে এই রোগের নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার এক নতুন মনােযােগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে পরিণত করেছে। এই জ্বর বয়স ভিত্তিতে হয় না। ছোট হোক কিংবা বড় ধনী হোক কিংবা দরিদ্র সকলেরই এই জ্বর হতে পারে। সেইজন্যই এর সম্পর্কে আলােচনা বর্তমানে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
ডেঙ্গু জ্বর কি?
এই ডেঙ্গু একটি স্প্যানিশ শব্দ। এর অর্থ হলো হাড়ভাঙা জ্বর। ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে এই জ্বরের উৎপত্তি। এই রোগের পেছনে মূলত এক মশাবাহিত একসূত্ৰক আরএনএ (RNA) ভাইরাস রয়েছে। স্ত্রী এডিস মশার (পুরুষ মশা নয়) কয়েকটি প্রজাতি এই ভাইরাস মানুষ পর্যন্ত বহন করে। এডিস ইজিপ্টাই মশা হল এদের মধ্যে অন্যতম। মশা শুধু ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস বহন করে না, হলুদ জ্বর এবং চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের বাহক হিসেবেও কাজ করে।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর এবং হেমােরেজিকডেঙ্গু জ্বর নামে দুই ধরনের ডেঙ্গু জ্বর হয়। উক্ত হেমােরেজিক ডেঙ্গু জ্বরটিকে আবার চার ধাপে ভাগ করা হয়, তা হল গ্রেড ওয়ান, গ্রেড টু, গ্রেড থ্রি এবং গ্রেড ফোর। তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরােটাইপও রয়েছে। সেগুলাে হলো- DEN-1, DEN-2, DEN-3 ও DEN-4। এদের মধ্যে দুই ও তিন নম্বর সেরোটাইপ হল সবচেয়ে মারাত্মক ধরনের সেরােটাইপ।
আবির্ভাবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
এই ডেঙ্গু জ্বরের আবির্ভাব হয়েছিল অনেক আগে। এ সম্পর্কে প্রথম বিবরণ পাওয়া গিয়েছিল ১৭৭৯ এবং ১৭৮০ সালে, যখন এশিয়া, আফ্রিকা এবং উত্তর আমেরিকা প্রমুখ মহাদেশগুলো এর মহামারির কবলে পড়েছিল।এর পরবর্তীতে ১৮২৮ সালের দিকে ডেঙ্গু কথাটির প্রচলন শুরু হয়েছিল।
এরপর এডিস মশার পরিবাহিত সম্পর্কে ১৯০৬ সালে সবাই নিশ্চিত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রচেষ্টায় এটি সফল হয়েছিল। ১৯০৭ সালের সময়কালে ভাইরাসঘটিত রােগগুলোর মধ্যে ডেঙ্গু রোগটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রামক রােগ হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবেশ বিপর্যয় ঘটার কারণে ডেঙ্গুর লক্ষণীয় বিস্তার দেখা গিয়েছিল। ১৯৭০ সালে আমেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিল এই ডেঙ্গু মহামারী।
ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার কারণগুলি
বর্তমানে ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী কোনো এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির স্ত্রী মশা যদি কোনাে ব্যক্তিকে কামড়ায় তবে সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি কোন মশা কামড়ায় তবে সেই মশাও বাহকে পরিণত হয়। কোনো রােগীকে দংশন করার দুই সপ্তাহ পরই সৎক্ৰমণক্ষম হয়ে উঠে সেই বাহক মশা এবং তার গােটা জীবনই সংক্রমণশীল হয়ে থাকে। এভাবে মশার কামড়ানোর মাধ্যমে একজন সুস্থ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলি
যেকোনাে ভাইরাসজনিত জ্বরের মতাে ডেঙ্গু জ্বরেও জ্বরের সাথে মাথাব্যথা, কাশি, গলাব্যথা, গাব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য ও বমি ভাব থাকে।
তাছাড়াও হাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়। এই জ্বরে মাথাব্যথার তীব্রতা বেশি থাকে চোখের পিছনে। আই মুভমেন্টেের ব্যথা আরও বেড়ে যেতে পারে ।
উপযুক্ত উপসর্গ দেখা দেয় ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুতে।
তবে হেমােরেজিক ডেঙ্গুতে গ্রেড ওয়ানে কোনাে রক্তক্ষরণ হয় না। কিন্তু গ্রেড টুতে চোখ, নাক ও চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে বমি এবং পেট ব্যথা বাড়তেই থাকে। গ্রেড থ্রি ও গ্রেড ফোরকে একত্রে শক সিনড্রোম নামে পরিচিত। গ্রেডথ্রিতে পালস বা নাড়ির
স্পন্দন ক্ষীণ হয়ে আসে। এছাড়া গ্রেড ফোরে নাড়ির স্পন্দন ও রক্তচাপ কোনােটিই পাওয়া যায় না।
ডেঙ্গু জ্বরের বিভিন্ন পর্যায়সমূহ
তিনটি পর্যায়ে ডেঙ্গু অতিবাহিত হয়ে থাকে। প্রথমত, জ্বর চলাকালীন সময়ে বাকেব্রাইল স্টেজ। এই সময় ভিন্ন মাত্রায় তাপমাত্রা
বাড়তে পারে। তবে জ্বর ছয় দিনের মধ্যে কমে যায়।
এই জ্বরের পরের সময়কে এফেব্রাইল ফেজ অথবা জ্বর পরবর্তী পর্যায় বলা হয়। আবার একে ক্রিটিক্যাল ফেজও বলা হয়।
এর কারণ হলো, ডেঙ্গুর জটিলতাগুলাে মূলত এসময়তেই শুরু হয়ে যায়। সিভিয়ার ডেঙ্গু এফেব্রাইল অথবা এর ক্রিটিক্যাল
পিরিয়ডের সময়, অর্থাৎ রােগের এই প্রভাব মূলত ষষ্ঠ, সপ্তম বা অষ্টম দিনে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এরূপ অবস্থার লক্ষণগুলাের
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রক্তচাপ দ্রুত কমে যাওয়া, রক্তবমি হওয়া, কালাে পায়খানা হওয়া, প্রস্রাবের সাথে রক্তপাত এবং ত্বকের নিচে রক্ত জমাট বাঁধা ইত্যাদি।
এসবের পাশাপাশি প্রস্রাবের পরিমাণও কম হয়ে যায়, ফুসফুসে জল জমে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। রক্তচাপ কম হয়ে যাওয়ায়
ফলে রােগী প্রলাপ বকতে শুরু করে, প্রায়ই অস্থির আচরণ করেতে শুরু করে। অনেক সময় বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে
দেয়। এই রােগের তৃতীয় পর্যায়ে দেহে আর তেমন জ্বর থাকে না। তবে দুর্বলতা গ্রাস করতে পারে আক্রান্তকে। একে ক্রোনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম বলা হয়ে থাকে।
চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বর হলে এর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি পাওয়া যায় না। এই রোগের রােগীর চিকিৎসার জন্য প্রথমেই প্রয়ােজন
হয় রোগীর ডেঙ্গু জ্বর সনাক্তকরণ। কারও জ্বর হলে, জ্বরের দ্বিতীয় দিন হতে চতুর্থ দিনের মধ্যেই যদি কেউ রক্ত পরীক্ষা করায়
তখন ডেঙ্গু এনএস-১ এন্টিজেন পজেটিভ হলে ডেঙ্গু জ্বর নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়।
ক্লাসিক্যাল এবং গ্রেড-১ হেমােরেজিক ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে নিজ বাড়িতেই চিকিৎসা করা সম্ভব। সাধারণত ডেঙ্গুর এই ধরনের
রােগীরা ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে রোগীকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী যথেষ্ট পরিমাণ পানি,
ডাবের জল এবং অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার পান করতে হবে।
তবে আক্রান্ত রোগী যদি খাবার গ্রহণ করতে না পারে তবে তাদের ক্ষেত্রে শিরা পথে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
রোগীর জ্বর কম করার ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট হয়। তবে ব্যথা কমাতে এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয়
কোনাে রকম ব্যথার ওষুধ খাওয়া উচিত না। কেউ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত।
প্রতিরােধে করণীয়
ডেঙ্গু জ্বর তথা ডেঙ্গুর রোগের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ঔষধ নেই। রোগীর দেহে থাকা প্রতিরোধ ক্ষমতাই এই রোগের
বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করতে পারে। তাছাড়া প্রতিকার করার চেয়ে প্রতিরােধই উত্তম, আর ভয়ংকর জ্বর প্রতিরােধ
করার মূলমন্ত্রই হল-এডিস প্রজাতির মশার উৎপত্তি এবং এর বিস্তার রােধ করা।
এটি প্রতিরােধের ক্ষেত্রে প্রথম তথা প্রধান করণীয় হল আপনার ডিম পাড়ার পরিবেশ ধ্বংস করা এদের ডিম পাড়ার সকল
উপযোগী স্থানগুলো পরিষ্কার রাখা।এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাড়ির আশেপাশে কোথাও যেন জল না জমে।
সারাদিন শরীরকে ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে রাখা উচিত যাতে করে এডিট মশা কামড়াতে না পারে। প্রয়ােজন হলে মসকুইটো
রিপেলেন্টও ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া বাড়িঘরের জানালাতে নেটব্যবহার করা যেতে পারে। দিনে কেউ যদি ঘুমায় তবে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো উত্তম।
শিশুদের ক্ষেত্রে হাত পা ঢাকা পোশাক গায়ে দিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। কেউ যদি এই রোগে আক্রান্ত হয় তবে সেই
ব্যক্তিকে সর্বদা মশারির ভেতর রাখতে হবে। তাছাড়াও মশা নিধন করার স্প্রে, কয়েল, ধূপকাঠি ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
পরিশেষে
মশাদের বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন। তবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আমাদের সবাইকেই বাড়ির চারপাশে মশা বৃদ্ধির অকুস্থল টায়ার,
পরিত্যাক্ত পাত্র, ডাবের খোসা ইত্যাদি সবকিছু পরিষ্কার রাখতে হবে। এছাড়া কয়েক সপ্তাহ পর পর মশানাশকারী রাসায়নিক ছড়িয়ে দিতে হবে।
নিজেরা সজাগ থাকার পাশাপাশি, অন্যদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। যাইহোক, এটি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগে স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এর জ্বর এবং এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ এ সম্পর্কে বিস্তারিত এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এটি আপনাদের অনেক উপকারে আসবে বলে মনে করছি।
আরওঃ
৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি
একাকিত্ব নিয়ে ফেসবুক ক্যাপশন কবিতা উক্তি এবং স্ট্যাটাস
মালয়েশিয়ায় সেরা কয়েকটি শ্রমিক ভিসা এর সুযোগ সুবিধা এবং বেতন